শনিবার, ১৩ই সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৯শে ভাদ্র ১৪৩২


সংকটে নেপাল, দীর্ঘমেয়াদি সমাধান সহসা কি আসবে?


প্রকাশিত:
১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১১:৩৮

আপডেট:
১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৩:৪৩

ছবি : সংগৃহীত

২০০৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজতন্ত্রের পতন হয়। এই পতনের পর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণে একের পর এক ঝাঁকুনি খেতে থাকা নেপালে অবশেষে তারুণ্যের বিপ্লবের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতন হলেও রাজনীতিবিদদের মধ্যে দুর্নীতির আধিক্য নেপালের সাধারণ মানুষকে কতটা হতাশ করেছে।

এর জবাব দিয়েছে তরুণ প্রজন্ম। তবে এখানে কথা উঠছে এই তরুণ প্রজন্ম আসলে রাষ্ট্রাচার এবং দুর্নীতির বিষয়ে স্বতঃস্ফূর্ত সচেতনবোধ থেকে আন্দোলন করে সরকারের পতন ঘটিয়েছে, নাকি তারা অন্য কারও স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করেছে।

ইতিমধ্যে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে তা হলো সবসময় রাজনীতির বাইরে থাকা নেপালের সেনাবাহিনী বর্তমান এই ক্রান্তিকালীন সময়ে রাজনীতির প্রধান অনুঘটক হয়ে কাজ করছে। জেন-জি বিক্ষোভকারীদের আন্দোলনে সরকারের পতন হলেও পতনপরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার গঠন প্রক্রিয়ায় তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি এই দুর্নীতিবিরোধী একটি সফল আন্দোলনের পরবর্তী প্রক্রিয়াকে সন্দেহের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

কে হবেন নতুন সরকারপ্রধান, কোন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে আগামী দিনগুলোয় রাষ্ট্র পরিচালিত হবে, এ নিয়ে তাদের মতপার্থক্যের জেরে কেউ কেউ এটাও মনে করছেন কাঠমুন্ডুর মেয়র বালেন্দ্র শাহ (Balendra Shah), একাধিক ত্রিশোর্ধ্ব মোটিভেটর, নেপালে সেনাবাহিনী কিংবা পতিত রাজতন্ত্র–সবকিছুই তরুণ প্রজন্মের পেছনে মূল শক্তি হিসেবে কাজ করে থাকতে পারে।

তবে সবকিছু ছাপিয়ে বর্তমান এই ক্রান্তিকালীন সময়ে বেশিরভাগ মানুষের কাছ থেকে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছেন দেশটির সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কি (Sushila Karki), যিনি দেশের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধান বিচারপতি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপসহীন এবং তার দায়িত্বপালন সময়কালীন সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীকে কারাদণ্ড দিয়ে মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি এবং নেপালি কংগ্রেসের জোট সরকারের রোষানলে পড়ে কিছুদিনের জন্য বরখাস্ত পর্যন্ত হতে হয়েছিলেন।

কার্কির পাশাপাশি আরও কিছু জনপ্রিয় নামের মধ্যে রয়েছে বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের প্রধান কুলমান ঘিসিং (Kulman Ghishing), তরুণ নেতা সাগর ঢাকাল (Sagar Dhakal) এবং ধারান শহরের মেয়র হার্কা সামপাং (Harka Sampang)।

বর্তমানে নেপালের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হলেন সুশীলা কার্কি। নেপালের গণমাধ্যম বলছে, সুশীলা কারকি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দিয়ে আগামী ছয় মাসের মধ্যে দেশটিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করবেন। তার সঙ্গে তিন সদস্যের একটি মন্ত্রিপরিষদ দায়িত্ব পালন করবে। কারা নতুন সরকারের মন্ত্রী হবেন, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এই পরিস্থিতিতে মন্ত্রীরা শপথ গ্রহণের আগপর্যন্ত সুশীলাই সব মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করবেন। প্রধানমন্ত্রীর শপথ নেওয়ার কিছুক্ষণ পর পার্লামেন্ট বিলুপ্ত করেছেন সুশীলা কারকি।

নেপালে সদ্য সংগঠিত হয়ে যাওয়া এই পরিবর্তনের কারণ নিয়ে চলছে অনেক বিশ্লেষণ এবং সমীকরণ। বলা হচ্ছে, রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা অবসানের পর নেপালের রাজনৈতিক সরকারগুলোর কোনোটাই জনপ্রত্যাশা ধারণ করে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারেনি। দেশের অনেক সমস্যার মধ্যে দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং উন্নয়ন সাধনের পরিবর্তে সরকার প্রধান থেকে শুরু করে সরকারের মন্ত্রীরা পর্যন্ত ব্যস্ত ছিলেন সীমাহীন দুর্নীতিতে।

শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে বেহাল দশা থেকে সাধারণ মানুষকে মুক্তি দেওয়ার পরিবর্তে তারা সবাই নিজেদের সন্তানদের লেখাপড়া এবং পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার জন্য বিদেশ পাড়ি দিয়েছেন। ফলশ্রুতিতে নেপালে তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এই ‘নেপো কিডস’ বিরোধী আন্দোলন।

প্রচলিত ধারার রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তে তরুণ সমাজের নেতৃত্বে এবং তাদের সামনে এগিয়ে আনার দাবিতে তরুণরা সংগঠিত হতে থাকে, যেখানে একপর্যায়ে যোগ দেন দেশের সাধারণ মানুষ। এর পক্ষে অনেকেই থাকলেও তরুণ প্রজন্মের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিলেন ৩৫ বছর বয়সী কাঠমুন্ডুর মেয়র বালেন্দ্র শাহ, যিনি বালেন শাহ নামে পরিচিত, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে নির্বাচিত হওয়ার পর তরুণরা আরও বড় স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। একসময়ের দারুণ জনপ্রিয় এই র‍্যাপ সিঙ্গার সরকারবিরোধী অনেক প্রতিবাদী গান গেয়েছেন, যা এই আন্দোলনকে উৎসাহ দিয়ে থাকতে পারে।

শুরুতে এই আন্দোলন দমাতে সরকারের পক্ষ থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দমন করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত পরবর্তীতে বুমেরাং হয়ে কাজ করে। সেনাবাহিনীর সহায়তায় প্রধানমন্ত্রীকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়, হেলিকপ্টারের রশি ধরে মন্ত্রীদের অনেককেই পালিয়ে যেতে দেখা যায়।

জনরোষ যে কতটা প্রবল ছিল এর প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে, যখন দেখা গেল দেশটির সাবেক একজন প্রধানমন্ত্রী এবং তার স্ত্রীকে বাড়িতে ঢুকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হলো। অর্থমন্ত্রীসহ সদ্য সাবেক বেশকিছু মন্ত্রীর ভাগ্যেও জুটেছে একই অবস্থা। এটা যে কেবল বর্তমান সরকারের আমলের অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতির কারণে ঘটেছে তা নয়, বরং তারা সব রাজনীতিবিদদের তাদের লক্ষ্যবস্তু করেছে।

আর এখানেই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, নেপালের এই আন্দোলনের পেছনে কেবল দেশের ভেতরের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ বা উদ্বেগ কাজ করেছে নাকি এর পেছনে আন্তর্জাতিক কোনো হস্তক্ষেপও ছিল। ইতিমধ্যে পদত্যাগ করা প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি জানিয়েছেন যে ভারতের কারণেই আজ তার এই অবস্থা।

নেপালের কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থিত এই নেতা যে কথা বলেছেন সেটা কতটুকু যৌক্তিক, তা ভিন্ন বিশ্লেষণের দাবি রাখে। তবে আমরা এটাও জানি বিগত প্রায় একদশক সময় ধরে চীন এবং ভারতের মধ্যে অনেক দ্বিপাক্ষিক সমস্যার মধ্যে একটি ছিল নেপাল।

এই সময়ে আলোচনার মধ্যমণি হয়ে ওঠা নেপালের সেনাবাহিনী রাজনৈতিক এই সংকটে যেভাবে সামনে চলে এসেছে তা থেকে এটাও অনেকেই অনুমান করছেন রাজনৈতিক নেতৃত্বের শূন্যস্থান পূরণ যদি দ্রুত সম্ভব না হয়, তাহলে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের ক্ষেত্র আরও প্রসারিত হতে পারে।

১৭ বছরে দেশে প্রধানমন্ত্রী পরিবর্তিত হয়েছে ১৩ বার। এরমধ্যে পুষ্প কমল দাহাল (Pushpa Kamal Dahal), গিরিজা প্রসাদ কৈরালা (Girija Prasad Koirala) এবং সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি (KP Sharma Oli) একাধিকবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন।

ক্ষমতার কেন্দ্রে নেপালি কমিউনিস্ট পার্টি এবং নেপালি কংগ্রেসের বাইরে নতুন কোনো দল বা সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়নি। সেক্ষেত্রে সর্বজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে নিয়ে সরকার গঠিত হলেও একটি রাজনৈতিক সরকারের অধীনে দেশ পরিচালিত হবে–এমনটা দ্রুত প্রত্যাশা করা যায় না।

ড. ফরিদুল আলম : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected], [email protected]
সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top