38039

09/05/2025 ফেসবুকে যা দেখছি সব কি বিশ্বাসযোগ্য নাকি ইমপোস্টার কনটেন্ট?

ফেসবুকে যা দেখছি সব কি বিশ্বাসযোগ্য নাকি ইমপোস্টার কনটেন্ট?

রাহাত মিনহাজ

৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১০:৩৩

১৬ জানুয়ারি ২০১৯। বুধবার। ওইদিন সন্ধ্যায় ওয়াশিংটন ডিসিতে অফিস ফেরত অনেকেই এক ভিন্ন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাগলাটে শাসনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তখন চরম নৈরাজ্য চলছিল।

শার্টডাউন কর্মসূচিতে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের প্রায় অচলাবস্থা, পদত্যাগ করেছেন হাউজের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি, লস এজেলেস-এ শিক্ষকদের কর্মবিরতি চলছে, নারীদের প্রতিবাদী মার্চ চলছে শহরে শহরে, হঠাৎ বেড়ে গেছে নির্বিচার গুলিবর্ষণে প্রাণহানির ঘটনা ইত্যাদি।

ট্রাম্পের এমন খামখেয়ালি কার্যক্রমে ত্যক্তবিরক্ত তিনজন প্রতিবাদকারী সংগঠক ওইদিন একটি সংবাদপত্রের ২৫ হাজার কপি বিলি করেছিলেন। এই সংবাদপত্রটি শুধু ওয়াশিংটন ডিসির বিভিন্ন সড়কেই নয় বিলি করা হয়েছিল হোয়াইট হাউজের সামনেও। বিলির সময় বলা হয়েছিলো, এটা ওয়াশিংটন পোস্ট এর বিশেষ সংখ্যা।

বিশেষ এই সংখ্যাটির আট কলামে প্রধান শিরোনাম ছিল UNPRESIDENTED। সাব-হেড ছিল TRUMP HASTILY DEPARTS WHITE HOUSE, ENDING CRISIS। এই সংবাদটি শুধু অফিস ফেরত মার্কিনিদের আকৃষ্ট করেনি, এই কপিটি আগুনের গতিতে ছড়িয়ে পড়েছিল অনলাইন পরিসরে। চরিত্রগতভাবে যা ছিল ছদ্মবেশী ভুয়া সংবাদপত্র। যাতে প্রকাশিত হয়েছিল ভুয়া সংবাদ। একাডেমিক ভাষায় যা পরিচিত Imposter Content নামে।

জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক সংস্থা-ইউনেস্কোর ব্যাখ্যা অনুযায়ী, এই প্রকারের ভুয়া সংবাদে মূলত একটি প্রতিষ্ঠিত, বিশ্বাসযোগ্য গণমাধ্যমের লোগো, রং, লেখার আকৃতি (ফন্ট) ও কাঠামো ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। যাতে পাঠক বা দর্শক-শ্রোতা সহজেই তা বিশ্বাস করে। যার মূল লক্ষ্য থাকে পাঠক-শ্রোতা-দর্শকদের বিভ্রান্ত করা। সম্ভব হলে তাদের মধ্যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে নিজের উদ্দেশ্য সাধন করা।

ওয়াশিংটনবাসী ও অনলাইনে এই কপিগুলো এতটা প্রভাব বিস্তার করেছিল যে, শেষ পর্যন্ত সংবাদপত্রটির মুখপাত্র ক্রিস কোরাট্টি (Kris Coratti) বিশেষ বিবৃতি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ক্রিস কোরাট্টি (Kris Coratti) বলেছিলেন, We will not tolerate others misrepresenting themselves as The Washington Post, and we are deeply concerned about the confusion it causes among readers. (Washington Post online, January 17, 2019)

অর্থাৎ, আমরা অন্য কাউকে ওয়াশিংটন পোস্ট হিসেবে ভুলভাবে উপস্থাপন করা সহ্য করব না। এর ফলে পাঠকদের মধ্যে যে বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে তা নিয়ে ওয়াশিংটন পোস্ট প্রতিষ্ঠান হিসেবে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।

২০০৮ সালেও এ রকম একটি ঘটনা ঘটেছিল। তখন প্রভাবশালী আরেক দৈনিক দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এর একটি সংখ্যা বেরিয়েছিল ১২ নভেম্বর ২০০৮। তখন বারাক ওবামা দেশটির প্রেসিডেন্ট এবং ইরাক যুদ্ধের অবসান নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছিল।

এরমধ্যে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এর ভুয়া সংখ্যা বের করা হয়। যার শিরোনাম ছিল ‘Iraq War Ends’। এই সংখ্যাটি বের করেছিলেন একদল অধিকারকর্মী, যারা কিছুটা মজার ছলেই এই কাজটি করেছিলেন। যে বিষয়কে একাডেমিক ভাষায় বলা হয় ‘Spoof Content’ বা মজার ছলে তৈরি করা Disinformation বা অপতথ্য।

উদ্দেশ্য মজা করা হলেও এর প্রভাবও প্রবল ছিল। অন্য সংবাদমাধ্যমের নেমপ্লেট, ফন্ট, সামান্য পরিবর্তিত নাম, রং ব্যবহার করে এই ধরনের অপতৎপরতা থেমে নেই। বরং দিনকেদিন এই প্রবণতা বাড়ছে। মানুষকে ধোঁকা দিয়ে ক্ষতি করার চেষ্টাও চলছে দিনরাত।

যে কারণে জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা বিষয়টি নিয়েছে গুরুত্বের সাথে। সংস্থাটি বলছে, এই ধরনের ছদ্মবেশী আধেয় (Spoof Content) ইন্টারনেট পরিসরকে বিপদজ্জনক করে তুলছে। যার ফলে তৈরি হচ্ছে তথ্য বৈকল্য বা Information Disorder।

জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ২০১৮ সালে Journalism, 'Fake News' and Disinformation: A Handbook for Journalism Education and Training শিরোনামের একটি গ্রন্থ প্রকাশ করে। এই গ্রন্থে Thinking about information disorder: formats of misinformation, disinformation, and mal-information শিরোনামের একটি অধ্যায় আছে, যা লিখেছেন ক্লারি ওয়ারডেল (Claire Wardle) ও হুসেইন ডেরাখশান (Hossein Derakhshan)।

দুই গবেষক এই অধ্যায়ে সাত ধরনের ভুল ও অপতথ্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। যেগুলোর মধ্যে অন্যতম সংবাদমাধ্যমের ছদ্মবেশী আধেয় বা Imposter Content।

ক্লারি ওয়ারডেল (Claire Wardle) ও হুসেইন ডেরাখশান (Hossein Derakhshan) ছদ্মবেশী আধেয় চ্যাপ্টারে লিখেছেন, There are real issues with journalists having their bylines used alongside articles they did not write, or organisations logos used in videos or images that they did not create. For example, ahead of the Kenyan elections in 2017, BBC Africa found out that someone had created a video with a photoshopped BBC logo and strap line, and it was circulating on WhatsApp. They therefore had to make a video that they shared on social media, warning people not to be fooled by the fabricated video.

(Page: 47-48, Journalism, 'Fake News' and Disinformation: A Handbook for Journalism Education and Training.)

অর্থাৎ, বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিকদের অনেক নিবন্ধ দেখা যায় যা কি না তাদের নিজেদের লেখা নয়, তবুও কোনো পক্ষ, ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তাদের বাইলাইন বা নাম ব্যবহার করে সেই নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। অপরদিকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের লোগো ব্যবহার করেও অনেক ছবি এবং ভিডিওর প্রচারণা দেখা যায় যা কিনা তাদের নিজেদের তৈরি নয়। উদাহরণস্বরূপ আমরা ২০১৭ সালের কেনিয়া নির্বাচনের আগের কিছু গল্প বা কাহিনি পর্যবেক্ষণ করতে পারি। বিবিসি আফ্রিকা তাদের পর্যবেক্ষণে একটি ভিডিও সামনে আনলো, যা কিনা বিবিসির লোগো এবং লাইন ফটোশপের মাধ্যমে ব্যবহার করে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম বিশেষ করে হোয়াটসঅ্যাপে প্রচারিত হচ্ছিল। এর ফলস্বরূপ তাদের নিজেদের একটি ভিডিও তৈরি করে তাদের সামাজিক মাধ্যমগুলোয় প্রচার করতে হয়েছিল, যার মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল জনসাধারণের প্রতি একটি সচেতনতামূলক এবং সতর্কবার্তা পৌঁছে দেওয়া। কোনো ব্যক্তি যাতে কোনো ধরনের বিভ্রান্তিকর ভুয়া ভিডিও অথবা সংবাদ দেখে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করেন।

২০১৮ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো যে বিপদের কথা বলেছিলো, সেই বিপদে এখন মোটামুটি বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুকের ফিড। এই ছদ্মবেশী সংবাদ কতটা ভয়ংকর তার একটা প্রমাণ পাওয়া যায় ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের সাড়া জাগানো অনুসন্ধানী অনুষ্ঠান তালাশ-এর উপস্থাপক ও অনুসন্ধানী সাংবাদিক মনজুরুল করিমের একটি ফেসবুক বার্তায়।

২৪ আগস্ট ২০২৫ তিনি লিখেছেন, ‘যমুনা টিভির ফটোকার্ড দেখে নিউজ পড়তে শুরু করি, পরে দেখি আনোয়ার টিভি’। শুধু মনজুরুল করিমই নন, একজন নাগরিক হিসেবে আমরা এখন প্রতিনিয়ত ছদ্মবেশী আধেয় সংবাদ বা Imposter News Content এর সম্মুখীন হচ্ছি।

কখনো জামেলা টিভি, কখনো আনোয়ার টিভি, কখনো কামবেলা, কখনো প্রথম আলু, কখনো চ্যানেল ৪২০ ফেসবুক ব্যবহারকারীদের প্রতারিত করার চেষ্টা করছে। কোনো প্রতিষ্ঠিত ও বিশ্বাসযোগ্য টেলিভিশন বা সংবাদপত্রের ফন্ট, রং, লোগো ব্যবহার করে প্রতিনিয়ত বার্তা দেওয়া হচ্ছে। যার প্রধান লক্ষ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের প্রতারিত করা।

মনে রাখা প্রয়োজন সংবাদ মাধ্যমের সবচেয় বড় সম্পদ হলো গ্রহণযোগ্যতা (Acceptance), বিশ্বাসযোগ্যতা (Trustworthiness) ও সুনাম (reputation)। দীর্ঘদিন পেশাদারিত্ব, মানবিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও মানবাধিকার রক্ষায় অতন্দ্র প্রহরীর কাজ করার পর সংবাদমাধ্যম মানুষের আস্থা অর্জন করে। তৈরি হয় সেই গণমাধ্যমের প্রাতিষ্ঠানিক মূল্য (Brand Value)। বর্তমান বিশ্বে যা অনেক কিছুর নির্ধারক।

তবে একবার এই বিশ্বাস ও সুনাম ক্ষুণ্ন হলে তা ফেরত পাওয়া খুবই কঠিন। সে জন্য মূলধারার, বিশ্বাসযোগ্য এই গণমাধ্যমগুলো অপচর্চার কারণে বেশ বিপদে রয়েছে। বিপদে রয়েছেন সাধারণ ব্যবহারকারীরাও। আর যেহেতু বাংলাদেশের মানুষের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম জ্ঞান ও শিক্ষা খুবই সীমিত সেহেতু এই বিপদ দিনে দিনে বাড়ছে।

ছদ্মবেশী আধেয় বা Imposter Content-এর বিপদ থেকে বাঁচার অনেক উপায় আছে। যেগুলোর মধ্যে অন্যতম আধেয়টি যথাযথ পর্যবেক্ষণ করা। দ্বিতীয় আরও একটি জরুরি কাজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের করা প্রয়োজন। তাহলো, কোনো অবস্থাতেই এই ধরনের আধেয় বা কনটেন্ট শেয়ার না করা। মনে রাখা প্রয়োজন, ব্যবহারকারীদের প্রতিক্রিয়া তৈরির জন্যই এই ধরনের আধেয় অত্যন্ত চতুরতার সাথে তৈরি করা হয়।

সহায়ক:

১। Journalism, fake news & disinformation: handbook for journalism education and training, (2018) UNESCO: Paris, France. Retrieved on 22-08-2025,

https://unesdoc.unesco.org/ark:/48223/pf0000265552/PDF/265552eng.pdf.multi

২। Fake editions of The Washington Post handed out at multiple locations in D.C. (The Washington Post, online), Retrieved on 22-08-2025,

https://www.washingtonpost.com/lifestyle/style/fake-editions-of-the-washington-post-handed-out-at-multiple-locations-in-dc/2019/01/16/1d6a0402-19a5-11e9-88fe-f9f77a3bcb6c_story.html

রাহাত মিনহাজ: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী
যোগাযোগ: রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল: [email protected], [email protected]